Saturday, September 1, 2018

সায়েন্স ফিকশনঃ কুমিল্লার রসমালাই

কলিংবেল টিপতেই একটা যান্ত্রিক আওয়াজে ভরে উঠলো চারপাশ। রূপার ভালো লাগে না এই বিরক্তিকর যান্ত্রিক আওয়াজ। বিরক্ত হয়ে অপেক্ষা করতে লাগলো।
কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই দরজা খুলে দিলো সামারা। মিষ্টি রিনরিনে গলায় বললো, “স্বাগতম রূপা!”
রূপা হালকা হাসল। তারপর ডাইনিং টেবিলে গিয়ে পানির জগটা তুলে নিলো। গ্লাসে না ঢেলে সোজা জগটা গলায় উপুড় করে দিয়ে ঢকঢক করে বরফশীতল পানি খেতে লাগলো। বেশ খানিকটা পানি খেয়ে লম্বা একটা নিঃশ্বাস ফেলে সামারার দিকে তাকালো।
ওকে লক্ষ্য করে সামারা বললো, “তুমি যেভাবে পানি খেলে তা তোমার জন্য ক্ষতিকর। তৃষ্ণার্ত অবস্থায় এভাবে দাঁড়িয়ে পানি খাওয়া পাকস্থলীর ক্ষতি করে। এজন্যেই তোমাদের নবিও বসে পানি খেতেন।”
রূপা একটু বিরক্ত হলো। ষষ্ঠ মাত্রার এ রোবটগুলো কারণে অকারণে কথা বলে।দেখতে মানুষের মতো হলে কি হবে, আসলে তো এরা যন্ত্রই! আর যন্ত্রের বকবকানি শুনতে কারই বা ভালো লাগে?
কিছু না বলে রূপা চুপচাপ নিজের ঘরে ঢুকে গেল।
বাইরের আগুনঝরা উত্তাপ থেকে রেহাই পেয়ে কিছুটা ভালো লাগলো রূপার। ঘরটা শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত, এই মুহূর্তে তাপমাত্রা ১৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস। বাইরে ভীষণ গরম, ৪৮ ডিগ্রি ছাড়িয়ে গেছে তাপমাত্রা, এই নভেম্বর মাসেও! গ্লোবাল ওয়ার্মিং কোনভাবেই নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। উন্নত দেশগুলো নিজেদের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করে রেখেছে, কৃত্রিম হিমবাহ প্রযুক্তির মাধ্যমে নিজেদের দেশে তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে রেখেছে, কিন্তু বাংলাদেশের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলো ভয়াবহ হুমকির মধ্যে রয়েছে। সমুদ্রে তলিয়ে যাওয়া কোনরকমে ঠেকানো সম্ভব হলেও, সূর্যের ঝলসানো উত্তাপ কোনভাবেই ঠেকানো যাচ্ছে না । তাদের মতো ক্ষমতাবান ধনী মানুষগুলো তবু এয়ার কন্ডিশন ব্যবহার করতে পারে, কিন্তু এ দেশের আশিভাগ মধ্যবিত্ত-নিম্নবিত্তরা এই প্রচণ্ড উত্তাপের মধ্যেই নিজেদের মানিয়ে নিচ্ছে কোনরকমে।
কাপড় ছেড়ে বাথরুমে ঢুকলো রূপা। শাওয়ার ছেড়ে দিলো, ঝরঝর করে পানি পড়তে লাগলো। অনেকক্ষণ ধরে গোসল করলো, শীতল পানির স্পর্শে মুহূর্তেই ক্লান্ত শরীর চাঙা হয়ে উঠলো।
গোসল সেরে কাপড় বদলে নিয়ে বাইরে বেরিয়ে এলো রূপা। টেলিফোন বাজছে, বিকট যান্ত্রিক আওয়াজ ছড়িয়ে পড়েছে। রূপা রিসিভার সুইচটা টিপে দিতেই হলোগ্রাফিক স্ক্রিনে ওর মায়ের অবয়ব ভেসে উঠলো।
“রূপা,আমার আর তোমার বাবার দুজনেরই আজ ফিরতে রাত হবে সোনা। তুমি খেয়েদেয়ে রেস্ট নাও, সামারার সাথে গল্প করো। রাতের বেলা আমরা একসাথে ডিনার করবো।”
“জানো আম্মু, আজকে ক্লাসে কি হয়েছে...” মায়ের কথাকে বিন্দুমাত্র পাত্তা না দিয়ে প্রবল উৎসাহে বলতে শুরু করেছিলো রূপা, কিন্তু ততোক্ষণে ওপাশ থেকে ফোনকল কেটে দেয়া হয়েছে। ভীষণ ব্যস্ত এখন ওর মা, দম ফেলবার ফুরসত নেই।
রূপা ডাইনিং টেবিলের দিকে এগিয়ে গেল, চেয়ার টেনে বসে পড়লো। সামারা আগে থেকেই প্লেট-গ্লাস সাজিয়ে রেখেছে টেবিলে।হটপটে জুঁইফুলের মতো গরম ভাত, ছোট একটা বাটিতে কচকচে সবুজ ঢেঁড়স ভাজি, আরেকটা হটপটে গরম ডাল আর ঝাল করে রান্না করা মুরগির মাংস। এমনিতে রূপা মাংসাশী গোছের, মাংস ছাড়া ওর চলে না। সারা পৃথিবীতে এখন কৃত্রিম প্রোটিনেরই চল, প্রাণী হত্যা করে মাংস খাওয়া আইনত নিষিদ্ধ। তবে সরকারের শীর্ষপর্যায়ের লোক হওয়ায় রূপার বাবা ঠিকই আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে সত্যিকারের মাংসের ব্যবস্থা করেন। যতই উন্নতমানের আর পুষ্টিসমৃদ্ধ হোক, আসল মাংসের সাথে কি আর কৃত্রিমভাবে তৈরি প্রোটিনের তুলনা চলে?
রূপাকে খাবার বেড়ে দিতে লাগলো সামারা। ষষ্ঠ মাত্রার এ রোবটগুলো মূলত গৃহকর্মী জাতীয় রোবট। প্রাচীনকালে পৃথিবীতে গৃহপরিচারিকা হিসেবে মেয়েদের নিয়োগ দেয়া হতো, বাংলা অভিধানে লেখা আছে তাদের নাকি ‘বুয়া’ নামে ডাকা হতো। সামারার মতো রোবটগুলোকে তৈরি করা হয়েছে বুয়ার বিকল্প হিসেবে। তাদের প্রোগ্রামেও সে ধরনের আচরণ ইনপুট করা। তাছাড়া এই রোবটগুলো পরিপূর্ণ নয়। বাংলাদেশে উন্নত জাতের রোবটগুলো আসে না। প্রোগ্রামে অসম্পূর্ণতা রয়ে গেছে, ভুলভাল কাজ করে এমন রোবটগুলোই সাধারণত এদেশে চড়া দামে রপ্তানি করে পশ্চিমারা। তাই প্রায়ই এরা উল্টোপাল্টা কাজ করে বসে।
তিন চামচ ভাত, মুরগির রানের টুকরো, দুই টুকরো আলু আর অল্প একটু ঝোল। ঝোল মাখিয়ে নিয়ে মাংস থেকে একটু ছিঁড়ে এক লোকমা ভাত মুখে দিলো রূপা।
অপূর্ব হয়েছে খেতে!এত ভালোমতো রান্না করা মুরগি আগে কখনো খেয়েছে বলে মনে পড়ছে না! রোজ দুপুরেই তো সামারার রান্না করা খাবার খায়। আজ এত অসাধারণ হলো কিভাবে?
মুগ্ধ হয়ে সামারাকে ডাকল রূপা। সামারা ছুটে আসতেই রূপা বললো, “এত ভালো রান্না করলে কি করে তুমি? খেতে তো দুর্দান্ত হয়েছে!”
সামারা মুখে একটা লজ্জা লজ্জা ভাব ফুটিয়ে তুললো।সামারা খুব একটা উন্নত রোবট নয়, তাছাড়া রোবটদের মানবিক অনুভূতি নেই, তবে সেরকম আবেশ চেহারায় ফুটিয়ে তুলতে পারে এমনভাবেই আজকাল রোবটগুলোকে তৈরি করা হয়। কোন পরিস্থিতিতে কিরকম আবেগের চিত্র চেহারায় নিয়ে আসতে হবে সেগুলো খুব সুন্দরভাবে সাজানো আছে এদের প্রোগ্রামে।
লজ্জা লজ্জা ভাব ধরে রেখে সামারা বললো, “ভালো করে পেঁয়াজ কষিয়ে নিয়ে তেল,লবণ,আদা-রসুন-জিরা বাটা,ধনিয়া,গরম মসলা,মরিচ আর হলুদ দিয়ে ভালো করে মাখিয়ে রান্না করেছি।”
“আর কিছু দাওনি? ঝোলটা এত গাঢ় থকথকে কি করে হলো?” প্রশংসার দৃষ্টিতে বললো রূপা।
“আর কিছু তো দেই নি।” তারপর হঠাৎ আর্কিমিডিসের মতো ভঙ্গিতে সামারা বললো, “ও হ্যাঁ, ফ্রিজে একটা সাদা রঙের দুধের মতো জিনিস ছিলো, ওটাও দিয়েছি।”
“সাদা জিনিস?”
“হ্যাঁ, ফ্রিজে রাখা ছিল।তোমার আম্মু, মিস.শাহানাকে একদিন দেখেছিলাম সাদা সাদা কি যেন ব্যবহার করে মুরগির রোস্ট রান্না করতে। তাই আজকে মুরগিতে এই রেসিপি প্রয়োগ করেছিলাম।এত ভালো লাগবে জানতে পারলে আরো কিছুটা দিতাম।”
রূপা খুশি হয়ে বললো, “নিয়ে আসো দেখি জিনিসটা। কি দিয়ে রান্না করেছো দেখে রাখি, আব্বুকে বলে আরো কয়েকটা আনিয়ে নেবো তাহলে।”
সামারা ঘাড় বাঁকিয়ে কিচেনের দিকে চলে গেল, রূপা খুশিমনে আরেক লোকমা ভাত মুখে দিলো। কি অপূর্ব!
সামারা হাতে একটা প্লাস্টিকের কৌটো এনে রূপার হাতে দিলো। রূপা কৌটোটা দেখেই ভীষণ চিৎকার দিয়ে উঠলো! সামারা একটু ভড়কে গেল, তারপর সামলে উঠে বললো, “কী হয়েছে?”
রূপা চিৎকার করেই বলতে লাগলো, “”তু-তু-তুমি এটা দিয়েছো মুরগিতে?আর এটা আম্মুকে কবে দিতে দেখেছো মাংসে?”
সামারা বললো, “ওই যে তোমার জন্মদিনের দিন রোস্ট রান্না করলেন যে,মাংসে মাখিয়ে রেখে দিলেন,”
সামারাকে থামিয়ে দিয়ে আরো জোরে চিৎকার করে রূপা বললো, “আম্মু যেটা দিয়েছিলো সেটা ছিল আলমারাই এর টকদই, সৌদি আরব থেকে আমদানি করা। আর তুমি মুরগির তরকারিতে কি দিয়েছো জানো?”
“কী?” সরল জিজ্ঞাসা সামারার।
“তুমি দিয়েছো, তুমি দিয়েছো...” বলতে বলতে একটু থেমে দম নিলো রূপা। তারপর গ্লাস থেকে একঢোক পানি খেয়ে সামারার দিকে পরিপূর্ণ ভাবে তাকালো।
“তুমি দিয়েছো কুমিল্লার বিখ্যাত রসমালাই!”
সামারার কপোট্রনে ইলেক্ট্রনের ছোটাছুটি আগের মতোই স্বাভাবিক রইলো। মেমোরি হাতড়ে খুঁজে বের করার চেষ্টা করলো, রসমালাই নামের জিনিসটা সম্পর্কে কোন তথ্য তার কাছে আছে কিনা!
চেষ্টা চলতেই লাগলো!



No comments:

Post a Comment